সূচনা:-
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এক সময় ভারতবর্ষের বুকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এল ধীরে ধীরে এদেশে তাদের শাসন ক্ষমতা বিস্তার করে। একদিকে যেমন তারা ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ অধিকার কে খর্ব করে ঠিক তেমনি ভারতবর্ষের উপর চালাতে থাকে নানা অত্যাচার। এই অত্যাচার যখন সীমা ছাড়ায় তখন ভারতের বীর বিপ্লবীরা আমরণ সংগ্রাম চালিয়ে নিজের দেশ মাতাকে ব্রিটিশদের শৃংখল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। এমনই একজন বিপ্লবী হলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। আগামী ২২ মার্চ আমাদের দেশ মায়ের বীর সন্তান মাস্টারদা সূর্য সেন এর জন্মদিন। তার জন্মদিনের আগেই জেনে নিন তার জীবনের নানা ঘটনাবলী সম্পর্কে।
পরিচিতি:-
১৮৯৪ সালের ২২ শে মার্চ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ায় এক বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার পিতা, তার নাম রাজমনি সেন। মায়ের নাম ছিল শশী বালা দেবী। তবে অল্প বয়সেই পিতৃহারা হয়ে নিজের কাকা গৌরমনি সেনের কাছে পালিত হন মাস্টারদা। ছোটবেলা থেকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সবই বিবেকানন্দের বাণী গুলিকে পাথেয় করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি।
শিক্ষাজীবন:-
মাস্টারদা সূর্য সেনের শিক্ষা জীবন শুরু হয় দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এই স্কুল থেকে নিজের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি ভর্তি হন নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই পড়াশুনা করে তিনি ভর্তি হন ন্যাশনাল হাই স্কুলে। এই সময়কালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারণে ভারত বর্ষ উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গ ঘোষণার প্রতিবাদে বাংলায় শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলন। পড়াশোনার পাশাপাশি সেই আন্দোলনের ব্রতেও উজ্জীবিত হতে শুরু করেন তিনি। এরপর ১৯১৬ সালে, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কলেজ, যা বর্তমানে বর্তমানে কৃষ্ণনাথ কলেজ নামে পরিচিত, সেখানে কলা বিভাগে ভর্তি হয়ে স্নাতক ডিগ্রি পান।
কর্মজীবন:-
পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে মাস্টারদা সূর্য সেন ব্রিটিশদের অত্যাচার এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন লক্ষ্য করেছিলেন। শুধু তাই নয় শিক্ষা জীবনে তিনি তার শিক্ষক ও ‘যুগান্তর’ বিপ্লবী দলের অন্যতম সদস্য শতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছ থেকে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছিলেন। এই বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সঙ্গে নিয়েই ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে আসেন তিনি এবং সেখানকার স্থানীয় ন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানেই ‘মাস্টার দা’ বলে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। যদিও কিছুদিন পরে তিনি চাকরি ছেড়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতিত্ব শুরু করেন।
বৈপ্লবিক কর্মকান্ড:-
তৎকালীন সময় বাংলাদেশের বিপ্লবীরা অনুশীলন ও যুগান্তর এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড চালাতেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, অনুরূপ সেন, নগেন সেন ওরফে জুলু সেন, চারুবিকাস দত্ত ইত্যাদি আরো অনেক বিপ্লবীরা। মাস্টারদা সূর্য সেন পরবর্তীকালে এসে যুগান্তর পার্টিতে যোগ দেন এবং এই পার্টির বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডকে আরো সক্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের দুই দলকে একত্রিত করে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আরো সঙ্ঘবদ্ধ করেন।
তার নেতৃত্বে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিরাট জনসভার আয়োজন হয়। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে সরাসরি যোগ দিয়েছিলেন মাস্টারদা। এ সময় তিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে নিজের শিক্ষক পেশাটিকেও ত্যাগ করেন। বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করার জন্য আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কোষাগার লুট করেন তিনি।
এই কাজের জন্য তার সহযোগীর সঙ্গে তাকেও দু’বছরের জন্য কারাবাসে থাকতে হয়। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অভিযানের সময় একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ৮০ জনেরও বেশি ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্য এবং ১২ জন বিপ্লবী নিহত হয়। ১৯২৯ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সূর্য সেন।
আরও দেখুন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী
তার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার থেকে পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর অস্ত্রাগারে অভিযান চালানোর জন্য বিপ্লবীদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। তারা অস্ত্রাগার চত্বরে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং সেখান থেকে পালিয়ে যান।
এ সময় আত্মগোপন করার জন্য মাস্টারদা সূর্য সেন কখনো কৃষক, কখনো পুরোহিত, কখনো গৃহকর্মী, কখনো বা ধার্মিক মুসলিম হিসাবে লুকিয়ে থাকতেন। তবে এক সময় নিজের বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে থাকার সময় তারই এক আত্মীয় নেত্র সেন ব্রিটিশদের এই খবর জানিয়ে দেন। অবশেষে ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ধরা পড়েন তিনি।
আরও দেখুন, স্বামী বিবেকানন্দ এর জীবনী
মৃত্যু:-
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে বন্দী হওয়ার পর ব্রিটিশ চালিত আদালতে সূর্য সেনের বিচার হয়। বিচারে তার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১২ জানুয়ারী ১৯৩৪ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে দেশ মায়ের এই বীর যোদ্ধা ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ বিসর্জন দেন। তারকেশ্বর দস্তিদার নামে আরও এক বিপ্লবীর ও ফাঁসি হয় এই দিন। সূর্য সেনের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন বিপ্লবী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। তাদের দীর্ঘ কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।
Written by Joyeeta Mukherjee.
Post Disclaimers
'whatsupbengal.in' একটি বাংলা অনলাইন ব্লগ নিউজ পোর্টাল। এই নিবন্ধে এবং আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রদত্ত তথ্যগুলি বিশ্বাসযোগ্য, যাচাই করা এবং অন্যান্য বড় মিডিয়া হাউস থেকে নেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছি। এই ওয়েবসাইটে দেওয়া বিষয়বস্তু শুধুমাত্র তথ্য ও শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে।
যোগাযোগ - wspbengal@gmail.com
নম্বর - 6297256750 (হোয়াটসঅ্যাপ)
আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন