পলিগ্রাফ টেস্ট, যা সাধারণত “লায়-ডিটেক্টর টেস্ট” নামে পরিচিত, একটি বিশেষ ধরনের পরীক্ষার পদ্ধতি যেখানে একজন ব্যক্তির শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে তার সত্য বা মিথ্যা বলার প্রবণতা যাচাই করা হয়। যন্ত্রটি বিভিন্ন শারীরিক প্যারামিটার যেমন হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি, এবং ত্বকের পরিবাহিতা পরিমাপ করে। এই প্রতিক্রিয়াগুলি রেকর্ড করে পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে আর জি কর মেডিকেল কলেজ কান্ডে এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হবে বলেই জানা গেছে।
এই পলিগ্রাফ টেস্টের প্রক্রিয়া:
পলিগ্রাফ টেস্ট সাধারণত তিনটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন হয়:
- প্রি-টেস্ট ইন্টারভিউ: এই ধাপে পরীক্ষক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিতি তৈরি করেন এবং পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। কিছু সাধারণ প্রশ্ন করা হয় যার উত্তর পরে মূল পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে তুলনা করা হবে।
- প্রশ্নোত্তর পর্ব: এই পর্যায়ে, ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হয়, যার মধ্যে কিছু সত্য ও কিছু মিথ্যা বলে জানানো হয়। ব্যক্তির শারীরিক প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করা হয় এবং তার ওপর ভিত্তি করে মিথ্যা বা সত্য যাচাই করা হয়।
- পোস্ট-টেস্ট ইন্টারভিউ: পরীক্ষার পর, পরীক্ষক ফলাফল বিশ্লেষণ করে এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন।
এ ধরণের পলিগ্রাফ টেস্টের উদ্দেশ্য:
পলিগ্রাফ টেস্টের মূল উদ্দেশ্য হল সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা। এটি বিশেষ করে নিরাপত্তা স্ক্রীনিং এবং অপরাধমূলক তদন্তে ব্যবহৃত হয়। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি উপস্থাপনকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে এই টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষ পলিগ্রাফ টেস্টে ব্যবহৃত যন্ত্র:
পলিগ্রাফ টেস্টের জন্য একটি বিশেষ মেশিন ব্যবহার করা হয়, যা চার থেকে ছয়টি সেন্সর দিয়ে সজ্জিত। এই সেন্সরগুলি শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া যেমন শ্বাসের হার, রক্তচাপ, এবং ত্বকের পরিবাহিতা পরিমাপ করে। মেশিনটি একটি কাগজের স্ট্রিপে গ্রাফ আকারে সংকেত রেকর্ড করে, যা পরে বিশ্লেষণ করা হয়।
ভারতে পলিগ্রাফ এর পরীক্ষা:
ভারতে পলিগ্রাফ টেস্টের ব্যবহার ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই টেস্টের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তির শারীরিক প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা হয়, যা তাকে সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
পলিগ্রাফ টেস্টের নির্ভরযোগ্যতা:
যদিও অনেক আইনজীবী এবং পলিগ্রাফ বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন যে এই পরীক্ষা ৮০% থেকে ৯০% নির্ভুল, তবুও জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল এর কার্যকারিতার কোনও স্থির প্রমাণ খুঁজে পায়নি। শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া অনেক সময় ব্যক্তির মানসিক অবস্থা বা স্ট্রেস দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যা টেস্টের ফলাফলকে সন্দেহজনক করে তুলতে পারে।
পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল এবং সময়সীমা:
একটি পলিগ্রাফ পরীক্ষার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাধারণত কয়েক ঘন্টা সময় লাগে। পরীক্ষার পর, পরীক্ষক ফলাফল বিশ্লেষণ করেন এবং একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। এই পরীক্ষার ফলাফল আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য না হলেও, এটি তদন্তকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করতে পারে।
পলিগ্রাফ টেস্টের প্রকারভেদ:
টেস্টের মধ্যে মূলত দুটি প্রধান প্রকার রয়েছে:
- কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স পলিগ্রাফ টেস্ট: এই টেস্টের মাধ্যমে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হয়।
- লাইফস্টাইল পলিগ্রাফ টেস্ট: এই টেস্টটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন ও অতীত আচরণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়, যা নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
পলিগ্রাফ টেস্টের সীমাবদ্ধতা:
- নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন: পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল সর্বদা নির্ভুল নয়। স্ট্রেস, উদ্বেগ, এবং অন্যান্য মানসিক বা শারীরিক অবস্থা পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
- কানুনিভাবে গ্রহণযোগ্যতা: অনেক দেশে পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়।
- নৈতিক প্রশ্ন: ব্যক্তির গোপনীয়তা এবং ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার কারণে পলিগ্রাফ টেস্টের ব্যবহার নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন উঠতে পারে।
পলিগ্রাফ টেস্টের মূল শারীরবৃত্তীয় প্যারামিটার
প্যারামিটার | পরিমাপ করা হয় | উদ্দেশ্য |
---|---|---|
হৃদস্পন্দন (Heart Rate) | মিনিটে বার | শারীরিক উত্তেজনা বা মিথ্যা বলার প্রতিক্রিয়া চিহ্নিত করা |
রক্তচাপ (Blood Pressure) | mmHg | মানসিক চাপ বা উদ্বেগের কারণে পরিবর্তন বোঝা |
শ্বাসপ্রশ্বাস (Respiration) | মিনিটে বার | শ্বাসের হার পরিবর্তন বিশ্লেষণ |
ত্বকের পরিবাহিতা (Skin Conductivity) | μS (মাইক্রোসিমেন্স) | ঘামের পরিমাণ বিশ্লেষণ |
পলিগ্রাফ টেস্টের বিভিন্ন প্রকারভেদ
প্রকারভেদ | বর্ণনা |
---|---|
কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স পলিগ্রাফ টেস্ট | ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হয় |
লাইফস্টাইল পলিগ্রাফ টেস্ট | ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন ও অতীত আচরণের বিশ্লেষণ |
এই পলিগ্রাফ টেস্টের প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ
- প্রি-টেস্ট ইন্টারভিউ
- প্রশ্নোত্তর পর্ব
- পোস্ট-টেস্ট ইন্টারভিউ
দেখুন পলিগ্রাফ টেস্টের সীমাবদ্ধতা
- পরীক্ষার নির্ভুলতা সন্দেহজনক হতে পারে।
- আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
- পরীক্ষার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
পলিগ্রাফ টেস্ট সম্পর্কে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর
- প্রশ্ন: পলিগ্রাফ টেস্ট কী?
উত্তর: পলিগ্রাফ টেস্ট, যা লাই ডিটেকটর টেস্ট নামে পরিচিত, একটি পরীক্ষা যেখানে শারীরবৃত্তীয় প্যারামিটার যেমন হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি, এবং ত্বকের পরিবাহিতা পরিমাপ করে ব্যক্তির সত্য বা মিথ্যা বলার প্রবণতা যাচাই করা হয়। - প্রশ্ন: পলিগ্রাফ টেস্ট কীভাবে কাজ করে?
উত্তর: পলিগ্রাফ টেস্টে ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়, এবং সেই সময় তার শরীরের শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া যেমন হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ রেকর্ড করা হয়। এই প্রতিক্রিয়াগুলি বিশ্লেষণ করে তার সত্যতা নির্ধারণ করা হয়। - প্রশ্ন: পলিগ্রাফ টেস্টের প্রকারভেদ কী কী?
উত্তর: পলিগ্রাফ টেস্টের দুটি প্রধান প্রকারভেদ রয়েছে: কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স পলিগ্রাফ টেস্ট এবং লাইফস্টাইল পলিগ্রাফ টেস্ট। - প্রশ্ন: পলিগ্রাফ টেস্টের উদ্দেশ্য কী?
উত্তর: পলিগ্রাফ টেস্টের প্রধান উদ্দেশ্য হল সন্দেহভাজন ব্যক্তির সত্যতা যাচাই করা এবং অপরাধমূলক তদন্তে সহায়তা করা। - প্রশ্ন: পলিগ্রাফ টেস্টের নির্ভরযোগ্যতা কতটা?
উত্তর: যদিও পলিগ্রাফ টেস্ট অনেক ক্ষেত্রেই ৮০% থেকে ৯০% নির্ভুল হতে পারে বলে দাবি করা হয়, তবে এর কার্যকারিতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে।
উপসংহার:
পলিগ্রাফ টেস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিতর্কিত প্রযুক্তি, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যদিও এটি অনেক সময় সহায়ক হতে পারে, এর নির্ভরযোগ্যতা এবং নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পলিগ্রাফ টেস্টের পাশাপাশি অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই প্রক্রিয়া আরও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। কোলকাতার আর জি কর মেডিকেল কাণ্ডে এর কতটা সফলতা আসতে পারে, এই নিয়ে আপনারা নিজেদের মতামত আমাদের জানাতে পারেন কমেন্টে। সকলেই চান, দোষী বা দোষীদের উপযুক্ত বিচার। প্রতিবেদন সম্পর্কে বিস্তারিত জানান কমেন্টে। ধন্যবাদ।
Post Disclaimers
'whatsupbengal.in' একটি বাংলা অনলাইন ব্লগ নিউজ পোর্টাল। এই নিবন্ধে এবং আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রদত্ত তথ্যগুলি বিশ্বাসযোগ্য, যাচাই করা এবং অন্যান্য বড় মিডিয়া হাউস থেকে নেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছি। এই ওয়েবসাইটে দেওয়া বিষয়বস্তু শুধুমাত্র তথ্য ও শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে।
যোগাযোগ - wspbengal@gmail.com
নম্বর - 6297256750 (হোয়াটসঅ্যাপ)
আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন