জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস জগৎ বিখ্যাত। পুরী রথযাত্রা এর মহা পূণ্য তিথি আজই। আর আজকের প্রতিবেদনে আলোচনা সেই নিয়েই। কখন শুরু হয়েছিল? কীভাবে শুরু হল? কি এই পুরী রথযাত্রার আসল ইতিহাস। চলুন তবে আর দেরী না করে শুরু করা যাক আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন। ‘উৎকলখণ্ড’ এবং ‘দেউল তোলা’ নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন।
জগন্নাথের মূর্তিগুলো হাত-পা বিহীন, বড়বড় চোখের এবং অদ্ভূতদর্শন কেন?
বৈষ্ণবীয় দর্শন মতে, একদা দ্বারকায় মহিষীগণ রোহিনী মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এত সেবা করার পরও তিনি যেন শ্রীদাম-সুদাম, কখনও মা যশোদা-নন্দ বা কখনও ব্রজবাসীগণ বলতে মুর্ছা যান।
তার কারণ কি?
তখন মাতা রোহিণী সুভদ্রাকে বললেন তুমি একটু দরজার বাইরে থাকো। এ বর্ণনা তুমি সইতে পারবে না। সুভদ্রাকে বাইরে রেখে মাতা রোহিণী মহিষীদেরকে বলতে লাগলেন কৃষ্ণ বিহনে বৃন্দাবনের তরু-লতা-পশু-পাখি কিভাবে হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ বলে কাঁদছে, কিভাবে মূর্ছা যাচ্ছে নগরবাসীরা। সখাগণ অনাহারে অনিদ্রায় কালাতিপাত করছে। মা যশোদা, পিতা নন্দ প্রতিদিন ছানা-মাখন নিয়ে গোপাল গোপাল বলে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন।
কৃষ্ণবিহনে ব্রজগোপীগণ প্রাণান্তপ্রায়। এদিকে ভগিনী সুভদ্রা দেবীকে একটি কক্ষের দ্বারে দেখতে পেয়ে কৃষ্ণ এবং বলরাম তাঁর নিকটে এসে দাঁড়ালেন। কক্ষাভ্যন্তর থেকে ভেসে আসা ধ্বনি, রোহিনী মাতা কর্তৃক বর্ণিত ব্রজবাসীদের কৃষ্ণ-বিরহ কথা শ্রবণ করতে করতে কৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রা বিকারগ্রস্ত হতে লাগলেন। তাদের হস্ত-পদ শরীরাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হতে লাগল। চক্ষুদ্বয় বিস্ফারিত হতে লাগল।
এমতাবস্থায় সেখানে নারদ মুনি উপস্থিত হয়ে সেই রূপ দর্শন করলেন। তখন নারদ মণি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করলেন, হে ভগবান, আমি আপনার যে রূপ দর্শন করলাম, যে ভক্ত বিরহে আপনি স্বয়ং বিকারগ্রস্ত হয়ে থাকেন, সেই করুণার মূর্তি জগতবাসীর কাছে প্রকাশ করুন। নারদ মুণির প্রার্থনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, দারুবৃক্ষ (জগন্নাথ) রূপে শ্রীক্ষেত্র বা পুরীতে আমি এই রূপে আবির্ভূত হবো।
বিশেষ দিনে দেখুন, পুরী রথযাত্রা সঙ্ক্রান্ত এই প্রতিবেদন।
পুরী রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। প্রথমে থাকে বলরামের রথ- ‘তালধ্বজ’। রথটির চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ ‘নীল’।
তারপর যাত্রা করে সুভদ্রার রথ। রথের নাম ‘দর্পদলন’। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। এই রথটির ধ্বজা বা পতাকায় ‘পদ্মচিহ্ন’ আঁকা থাকে, তাই রথটিকে ‘পদ্মধ্বজ’ও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ ‘লাল’।
সবশেষে থাকে জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম ‘নন্দীঘোষ’। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম ‘কপিধ্বজ’। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুট। রথটির আবরণের রঙ ‘হলুদ’। তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগের রঙ ‘লাল’।
রথযাত্রার মোক্ষ বা পূণ্য কি?
আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত এই পুরী রথযাত্রা কিংবা পুনর্যাত্রা অর্থাৎ উল্টোরথ, রথোপরি ভগবান জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রাদেবীকে দর্শন করলে এই জগতে আর পুর্নজন্ম হবে না। সনাতন ধর্মতত্ত্ব:-আষাঢ়ে প্রভু জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা, শ্রীমৎ নারায়ণ পুরী মহারাজ।
রথযাত্রায় লোকারণ্য, মহা ধুমধাম। পুরী রথযাত্রা অনুষ্ঠানে ভক্তেরা লুটিয়ে প্রণাম করছে। জগদীশ্বর জগন্নাথ অগ্রজ বলভদ্র ও ভগিনী সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে রথারোহণ করেছেন। তিনি মন্দিরের রত্নবেদী থেকে ভক্ত দর্শনে জনপথে নেমে এসেছেন। তিনি যে ভক্তাধীন, ভক্তপ্রিয়; ভক্তেরই ভগবান। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথির পুণ্যদিনে এই রথযাত্রা উৎসব হয় প্রতিবছর। জনতা জনার্দনের রথের রশি টেনে নিয়ে যায়। ভক্ত না হলে ভগবানের চলে না।
অন্তর্যামী চিরদিন অন্তরে থাকেন, লীলা করেন। এই সেই দেবতা যিনি জনারণ্যে বেরিয়ে আসেন। শাস্ত্রে আছে, ‘রথে তু বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’। হৃদয় গুহায় যে আত্মা বিরাজ করেন তাঁকে দেখলে পুর্নজন্ম আর হয় না। ‘পুনরপি জননং পুনরপি মরণং’অর্থাৎ পুনরায় জননী জঠরে শয়ন আর হয় না। তখন জন্ম মরণ থেকে চিরদিনের জন্য অব্যাহতি পায়। রথযাত্রা উৎসবের গভীরে এই তত্ত্বই অন্তর্নিহিত। কবির ভাষায় : রথ ভাবে আমি দেব/পথ ভাবে আমি/উভয়ের কথা শুনে হাসেন অন্তর্যামী।
রথযাত্রার বাকি ইতিহাস দেখুন।
চট্টলার বুকে পাহাড় শিখরে তুলসীধামে শ্রীশ্রী মদনমোহন নরসিংহ গোপাল জীও’র মন্দিরে জগন্নাথ-সুভদ্রা ও বলরামের শ্রী বিগ্রহ অনেক দিন থেকে নিত্য পূজিত। ১৮শ’ খৃষ্টাব্দের পর থেকে তুলসীধামে রথযাত্রা উৎসবের প্রচলন শুরু হয়। জগন্নাথ তো স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পুরী রথযাত্রা এর এই শুভদিনে মহানির্বাণতীর্থ তুলসীধাম পরিণত হয় ভক্ত আর ভগবানের মহামিলন তীর্থে। শ্রীশ্রী জগন্নাথের দর্শন অভিলাষী হাজার হাজার আবালবৃদ্ধ ভক্তপ্রাণের সমাবেশ ঘটে। রথযাত্রা উৎসবের মূল কেন্দ্র শ্রীক্ষেত্র পুরীর পুরুষোত্তম ধাম। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গ্রামে-গঞ্জে-নগরে জগন্নাথ রথ পরিক্রমায় বের হন।
পুরীধামে তিন দেবতা তিনটি রথে আরোহণ করেন। পুরী রথযাত্রা অনুষ্ঠানে সবার পেছনের রথখানিতে থাকেন শ্রী জগন্নাথ। অন্যত্র একই রথে তিনজন। এই রথের রশি ধরার জন্য কতো হুড়োহুড়ি। এসবের মূল বিষয় দেবতার কৃপা লাভ ও পুণ্য অর্জন। ঋষি শিল্প গভীর তত্ত্বাবগাহী। কে এই জগন্নাথ? তিনি জগতের নাথ বা প্রভু। জগতের ধারক, বাহক ও পরম পালক। তারপরের অবস’ানে সুভদ্রা। লৌকিক জগতে পরম প্রভু পুরুষোত্তমের ভগ্নি। সু অর্থ সুন্দর।
ভদ্র অর্থে কল্যাণ ও মঙ্গল। সুভদ্রা হচ্ছেন শুভ ও সুন্দরের প্রতীক। সুভদ্রার পরে বলরাম। বলরাম ত্রাণশক্তি। শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা ও উপনিষদে পরব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘সর্বেন্দ্রিয় গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয় বিবর্জিতম্’। ইন্দ্রিয়গ্রাম না থাকলেও তাঁর মধ্যে সব ইন্দ্রিয় ও গুণের আভাস আছে। ইন্দ্রিয় বিরহিত হয়েও তিনি সবকিছু দর্শন, স্পর্শ, শ্রবণ করতে পারেন। চরণ না থাকলেও সর্বত্র বিচরণ করতে পারেন।
কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত কঠোপনিষদ হলো যম-নচিকেতা সংবাদ।
যজুর্বেদের দু’টি ভাগ। শুক্ল যজুর্বেদ ও কৃষ্ণ যজুর্বেদ। কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত কঠোপনিষদ হলো যম-নচিকেতা সংবাদ। যম নচিকেতাকে আত্মতত্ত্বের সংবাদ দিয়ে বললেন-‘‘আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেবতু। বুদ্ধিং তু সারথি বিদ্ধি মন প্রগ্রহমেব চ ॥ ইন্দ্রিয়ানি হয়ানাঞ্চ বিষয়াংসে’ষু গোচরান। আত্মেন্দ্রিয় মনোযুক্ত ভোক্তত্যাহর্মনীষিনং ॥” অর্থাৎ, হে নচিকেতা! আত্মাকে রথী, শরীরকে রথ, বুদ্ধিকে সারথি, মনকে বল্গা ও ইন্দ্রিয়বর্গ সেই রথের অশ্ব এবং দেহ, মন ইন্দ্রিয়যুক্ত আত্মাই সব কিছুর ভোক্তা।
আমাদের জীবনের দুইদিকে আছে জীবাত্মা ও পরমাত্মা। জীবাত্মা ষড়রিপুর জালে জড়িয়ে পড়ে সবকিছু ভোগ করতে চায়। মন যদি বল্গাহারা, চঞ্চল ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে তবে তার লাগাম টেনে ধরা চাই। মন বেপরোয়া হলে বিপদ ঘটে। মন ইন্দ্রিয়ের অধিপতি। ইন্দ্রিয়গ্রামের লাগাম টেনে না ধরলে সে রথচক্র দুরন্ত বেগে ছুটতে গিয়ে ভেঙ্গে পড়বে। দেহপুরে আত্মারূপে যিনি বিরাজ করেন তাঁকে জানাই দুঃখমুক্তি ও আনন্দ লাভের উপায়। রথের সারথি ভগবান যদি দেহরথখানি পরিচালনা করেন, সাধক তখন আনন্দ সাগরে ভাসেন। দেহমন তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।
যোগ সঙ্গীতের বর্ণনায় আছে-
দেহ কুরুক্ষেত্র মাঝে বিরাজে নর নারায়ণ,
দশদলে ধনঞ্জয় দ্বিদলে মধুসূদন।
রবরা যত সৈন্য ইন্দ্রিয় রূপেতে গণ্য,
প্রকাশে যুদ্ধ নৈপুণ্য মানে না কারও শাসন।
দেহ ইন্দ্রিয় কোন শাসন মানতে চায় না। আপথে-বিপথে চলে আসক্তির কানা গলিতে পথ হারায়। আত্মশক্তির ক্ষয় করে ফেলতে চাইলেও দেহের ভগবৎ শক্তি বিরাজমান থাকে। সেই শক্তিকে চিনে নিতে পারার মধ্যে রয়েছে জীবনের সার্থকতা। রথ থেমে যায়, যদি রথ সারথিবিহীন হয়। মন্দিরে যদি মাধব না থাকে তবে কোন পূজা চলে না। অপশক্তি ততদিন সক্রিয় থাকে, যতদিন ভগবানে আত্ম সমর্পিত হতে না পারি। কালের স্মরণী ধরে জগন্নাথের রথযাত্রা নিত্য চলছে। সে পথে দেহ রথকে পরিচালনা করার মধ্যে নিহিত আছে রথযাত্রার সফলতা।
সনাতন ধর্মতত্ত্ব:- শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার মাহাত্ম্য।
শাস্ত্রে আছে, ‘রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’। রথের ওপর খর্বাকৃতি বামন শ্রী শ্রী জগন্নাথকে দর্শন করলে তার পুনর্জন্ম হয় না। এ বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে ভোর হতেই ভক্তরা প্রাণের টানে ছুটে আসেন প্রেমোরথের প্রাণের ঠাকুরকে নিয়ে স্নানযাত্রার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ রথের রশি ধরে টানতে। রথটানা শুরু করতেই আশ্চর্যভাবে অনেকটা ভারাক্রান্ত ও বেদনাচ্ছন্ন হয়ে ঘন মেঘ দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে মাটির পৃথিবীতে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে।
অবশেষে গ্যাসের দাম কমালো কেন্দ্র, ১০০০ টাকার নিচেই মিলবে সবার!
সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নেচেগেয়ে উচ্ছ্বাসের প্লাবনে মতোয়ারা হন সবাই। সেই সঙ্গে সমানতালে বাজতে থাকে ঘণ্টাবাদ্যি। একদিকে পুরুষেরা শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসা, ঢাক, ঢোল বাজিয়ে পরিবেশ মুখর করে তোলেন অন্যদিকে নারীরা উলুধ্বনি ও মঙ্গলধ্বনির মাধ্যমে রথটানায় আনন্দচিত্তে শামিল হন। রথ থেকে রাস্তায় দাঁড়ানো দর্শনার্থীদের দিকে ছুড়ে দেয়া হয় কলা আর ধানের খৈ।
প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপর যুগে লীলা সম্বরণের পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ, বলরাম, সুভ্রদা-এ তিন রূপের পুনঃউদঘাটন এক আশ্চর্য সংবাদও বটে। শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় সমাগম হয় লাখ লাখ ভক্তের, যার ফলে সৃষ্টি হয় সমন্বয় ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
জয় জগন্নাথ, জয় জগন্নাথ!
সেই সঙ্গে রথ থেকে দেয়া হয় আশীর্বাদ ও প্রসাদ ভক্তবৃন্দ তা গ্রহণ করে হন কৃতার্থ। রথে থাকেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। ভক্তবৃন্দ ভক্তি সহকারে রথরজ্জুর মাধ্যমে রথকে টেনে এগিয়ে নিয়ে যান। আর এ দৃশ্য দেখার জন্য আবেগপ্রবণভাবে ভক্তবৃন্দ এবং বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষ অবস্থান নেন। কারণ রথরজ্জু ধরে রথটানা মহাপুণ্য কর্ম বলে সনাতন ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
কঠোপনিষদ বলেছেন, ‘আত্মা হলো রথী, শরীর হলো রথ, বুদ্ধি হলো সারথি, মন হলো লাগাম। মনীষীরা ইন্দ্রিয়গুলোকে দেহরথের অশ্ব বিষয়গুলোকে ইন্দ্রিয়গুলোর বিচরণ ভূমি এবং দেহ-মন ও ইন্দ্রিয়যুক্ত আত্মাকে ভোক্তা বলেছেন। যে পুরুষের সারথি (বুদ্ধি) অসংযত মনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবিবেকী হয় তার ইন্দ্রিয় সব লৌকিক সারথির দুষ্টু অশ্বের মতো আপন বশে থাকে না। কিন্তু যার বুদ্ধি বিবেকবান, মন সংযত, যার অন্তঃকরণ সর্বদা পবিত্র, তিনি সেই পরম পদপ্রাপ্ত হন। তাকে আবার আর সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয় না।
প্রাণ থাকা পর্যন্ত দেহকে অবহেলা করতে নেই।
সে পরমপদ প্রাপ্তি অর্থাৎ অভীষ্ট লক্ষ্যের পথ অতি দুর্গম, এ জন্য উপযুক্ত ‘যান’ প্রয়োজন। ‘রথ’ পথযাত্রার একটি প্রকৃষ্ট যান। এ রথের সুযোগ্য চালক বা সারথি প্রয়োজন, তার সঙ্গে প্রয়োজন শক্তিশালী বশীভূত তথা বিশ্বস্ত অশ্ব ও সুদৃঢ় লাগাম। শাস্টত্রকাররা রূপক ছলে বলেছেন, অবিদ্যাবশে সংসারী জীবনের এ দেহটাই ‘রথ’ এবং রথের অধিষ্ঠাতা আত্মীয় ‘রথী’। সুতরাং, প্রাণ থাকা পর্যন্ত দেহকে অবহেলা করতে নেই। তাই ঋষিরা বলেছেন, আত্মা নং বিদ্ধি আত্মাকে জানো, রথযাত্রায় চরম আধ্যাত্মিক রহস্যকে সূক্ষ্ম রূপে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রেমিবিগলিত জগন্নাথের দেহটির বর্ণনা গৌড়ীয় দর্শনের আচার্যরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকালীলায় ১৬ হাজার আটজন প্রধান মহিষীকে নিয়ে চরম বিলাস করেছেন। কিন্তু প্রায়ই রাতে ‘রাধা’ ‘রাধা’ বলে চিৎকার করে কাঁদা দেখে একদিন সত্যভামাসহ মহিষীরা কান্নার কারণ জানার জন্য মা রোহিনীর কাছে উপস্থিত হলেন এবং জানার প্রত্যাশা নিবেদন করলেন। বন্ধুদের ব্যাকুলতা দেখে অন্তঃপূরের দরজায় সুভদ্রা বোনকে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করে বৃন্দাবনের প্রেমলীলাতত্ত্বের ওপর বক্তব্য শুরু করেন।
এই প্রেক্ষাপটে পুরী রথযাত্রা অনুসারে, বলরাম আকর্ষিত হয়ে দরজায় এসে হাজির হলেন। সুভদ্রা বললেন, মাতা রোহিনীর নিষেধ রয়েছে ভেতরে যেতে। এরপর কৃষ্ণ এসে হাজির। বোনের কথায় বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সুভদ্রার ডান দিকে দাদা বলরাম, বাদিকে কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেসে আসা লীলাকথা শুনতে থাকলেন। এ মধুময় প্রেমতত্ত্বের আলোচনা শ্রবণ করে তিনজন প্রেম বিগলিত হয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে গেলেন। এ অবস্থায় দেবর্ষী নারদ এসে উপস্থিত হলেন। এ প্রেম বিগলিত স্বরূপ দর্শন করে নারদ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, বহুদিন পরে ব্রজলীলার কথা শুনতে পেলাম।
আজ বড় আনন্দের দিন।
নারদ এ অবসরে তুমি কিছু বর প্রার্থনা কর। ভক্তপ্রবর দেবর্ষী নারদ বললেন, প্রভু এ প্রেম বিগলিত স্বরূপ যেন জগতবাসী জীবের নয়ন গোচর হয় এ প্রার্থনা। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, দারুব্রহ্মস্বরূপ জগদ্বাসী অবশ্যই দেখতে পাবে এবং তোমার, শিবপার্বতীর ইচ্ছায় আমার অন্ন ব্রহ্মরূপও প্রকাশ পাবে। নীলাচল ধামে তিনটি মন্দির-গম্ভীরা মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, গু-িচা মন্দির। শ্রীকৃষ্ণ রাধাভাবে শ্রীকৃষ্ণের জন্য কেঁদেছেন স্থান গম্ভীরা, রাধার বিরহে কৃষ্ণ কেঁদেছেন স্থান জগন্নাথ মন্দির, রাধা কৃষ্ণ বিরহে কেঁদেছেন স্থান গুন্ডিচা মন্দির।
রথে আরোহণ করে যাত্রা বলেই রথযাত্রা রথীহীন রথে যাত্রা নেই। তেমনি জীবনদেহও রথী শূন্য নয়। আমাদের মানবদেহে রথী আছেন দেহ থেকে রথী বিচ্ছেদ ঘটলে পৃথিবীর ভাষায় মৃত্যু। এ সত্য শুদ্ধ সত্তা আছেন বলেই জীবের দেহরথ চলে। দেহের প্রাণ নামক সত্য সত্তাই জগন্নাথ। দ্বারকায় অবস্থানকালে বৃন্দাবনের প্রেমকথা শ্রবণ করে শ্রীকৃষ্ণের বাসনা জেগেছিল একবার বৃন্দাবনে যাওয়ার। জগন্নাথ মন্দির থেকে জগন্নাথ বিগ্রহকে রথে চড়িয়ে গু-িচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া অর্থ জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে যাত্রা।
মন্দিরে জগন্নাথ বিগ্রহকে ৭ দিন রাখার পর পুনঃশ্রীমন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা অর্থ আবার দ্বারকায় আসা- এটি ফিরতি রথ বা উল্টোরথ নামে খ্যাত। অন্তরে কৃষ্ণ বাইরে রাধা তিনি কলিকালে শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে হলেন চৈতন্য মহাপ্রভু। আর অন্তরে রাধা বাইরে কৃষ্ণ হলেন জগন্নাথদেব। দু’জনের মিলন হলো লীলাচলে। ষোড়শ শতাব্দীতে মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস গ্রহণ করে নীলাচলে এলে জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রার উৎসব বৃহত্তর আঙ্গিকে শুরু হয়, যা আজ অবধি বিশ্বে পরিব্যাপ্ত।
অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেবের মূর্তি বুদ্ধদেবেরই রূপান্তর। আবার অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেব কোনো অনার্য জাতির দেবতা। বিবর্তনের ধারায় হিন্দুদেবতা বিষ্ণু এবং সব শেষে জগন্নাথদেব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এর পেছনে যুক্তিও আছে-স্কন্দপুরাণে উৎকলখ-ে এবং পুরষোত্তমখ-ে শবরপতি বিশ্বাসুর ছিলেন নীলগিরি পর্বতে নীলমাধবের পূজারী এবং উপাসক।
বিবর্তনের ধারায় হিন্দুদেবতা বিষ্ণু এবং সব শেষে জগন্নাথদেব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
পরে নীলমাধব এখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে কাঠদ্বারা নির্মিত জগন্নাথদেবের মূর্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শবরপতি বিশ্বাসুর অনার্য জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলেই জগন্নাথদেবকে অনার্যদের দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ, বৌদ্ধ ত্রিরত্মের মধ্যে সংঘ নারীরূপে বুদ্ধের ও ধর্মের মাঝখানে অবস্থান করায় জগন্নাথদেবের মূর্তি ত্রিরত্মের রূপান্তর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
স্বামী অভেদানন্দ তিব্বতের লাদাখ অঞ্চল ভ্রমণকালে ‘বৌধখুর্ব’ গ্রামে ত্রিরত্মের যে মূর্তি দেখেছিলেন, সেই মূর্তিগুলোকে তিনি জগন্নাথদেবের মূর্তির প্রতিরূপ বলে গণ্য করেছেন। স্বামীজীর বর্ণনা অনুসারে লামাদের একটি ত্রিরত্ম বা ‘পরমেশ্বরা’ রহিয়াছে। আমাদের দেশের ইট দিয়ে গাঁথা তুলসী মন্দিরের মতো ইহারা তিনটি ক্ষুদ্র নিরেট মন্দির নির্মাণ করিয়া প্রথমটিতে কালো, দ্বিতীয়টিতে হলদে ও তৃতীয়টিতে সাদা রঙ লাগাইয়া বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতীক নির্মাণ করিয়া তাহাদের পূজারতি করেন। ইঁহারা এইগুলিকে ‘পরমেশ্বরা’ বলেন। ‘পরমেশ্বরা’ শব্দ পরমেশ্বর শব্দের অপভ্রংশ। এইগুলোতে চোখ অাঁকিয়া দিলে প্রথম কালোটিকে হস্তপদহীন জগন্নাথ, দ্বিতীয় হলদেটিকে সুভদ্রা ও তৃতীয় সাদাটিকে বলরাম মনে হয়।
উড়িষ্যার অনেক বৈষ্ণব ভক্তকবি জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের মূর্তি বা অবতার বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস শ্রীকৃষ্ণই বুদ্ধরূপে জগন্নাথ নামে অধিষ্ঠিত। জগন্নাথ দাসের ‘দারুব্রহ্ম’ ও অচ্যুতানন্দ দাসের রূপান্তর ‘শূন্য সংহিতা’য় এই তত্ত্ব স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর দাস ও অচ্যুতানন্দ জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের এবং শ্রীচৈতন্যদেবকেও বুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন।
সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রার সঙ্গে সর্ষাগমনের সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ।
উৎকলখর বর্ণনা অনুসারে জগন্নাথদেব শঙ্খচক্রধারী, সুতরাং দ্বিভূজ। কিন্তু প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে বিশ্বকর্মা জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করার সময় কারো প্রবেশ ছিল নিষেধ, এমনকি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নেরও না। বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরি করার আগেই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অধৈর্য হয়ে বন্ধ দরজা খোলার জন্য মূর্তি অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। আমরা যে রথযাত্রা উৎসব পালন করে থাকি তা জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রা সূর্যের অয়নপথ পরিক্রমার সাথে সংশ্লিষ্ট।
সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রার সঙ্গে সর্ষাগমনের সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। আর বর্ষা শুরুর উৎসব জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। জগন্নাথদেব সূর্য-সপ্তাশ্ব বাহিত রথে আকাশলোক পরিক্রমণ করেন। তারপর রথে অরোহণ করে যাত্রা করেন। অয়নপথে সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা ও উত্তরে প্রত্যাবর্তন জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ইতিবৃত্ত।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রার উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। রথযাত্রা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য মিলন মেলা। এই দিনে এখানে নানা ধর্মের-বর্ণের লোক জগন্নাথদেবের মূর্তি এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে সমবেত হয়। জগন্নাথদেবও তার জগৎকল্যাণময় মূর্তি নিয়ে মন্দিরের পূজাবেদী হতে বেরিয়ে এসে রথারোহণে যাত্রা শুরু করেন। বছরে একবার দর্শন দিয়েও তিনি অসংখ্য ভক্তের চিত্তবিহারী হয়ে ভক্তহৃদয়ে অবস্থান করেন। আজকের প্রতিবেদন এখানেই শেষ করছি। আজকের দিনটি সকলের খুব ভালো কাটুক।
Post Disclaimers
'whatsupbengal.in' একটি বাংলা অনলাইন ব্লগ নিউজ পোর্টাল। এই নিবন্ধে এবং আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রদত্ত তথ্যগুলি বিশ্বাসযোগ্য, যাচাই করা এবং অন্যান্য বড় মিডিয়া হাউস থেকে নেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছি। এই ওয়েবসাইটে দেওয়া বিষয়বস্তু শুধুমাত্র তথ্য ও শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে।
যোগাযোগ - wspbengal@gmail.com
নম্বর - 6297256750 (হোয়াটসঅ্যাপ)
আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন